ট্রলি প্রবলেম ও সেলফ ড্রাইভিং কার

থট এক্সপেরিমেন্ট এবং প্যারাডক্স গুলোর মধ্যে ট্রলি প্রবলেম অন্যতম জনপ্রিয় একটি এক্সপেরিমেন্ট।

ট্রলি প্রবলেম ও সেলফ ড্রাইভিং কার

থট এক্সপেরিমেন্ট এবং প্যারাডক্স গুলোর মধ্যে ট্রলি প্রবলেম অন্যতম জনপ্রিয় একটি এক্সপেরিমেন্ট। এটিকে ট্রলি ডিলেমাও বলে থাকেন অনেকে। ১৯০০ সালের দিকে এই এক্সপেরিমেন্টটি দার্শনিক সমাজে ব্যাপক সাড়া ফেলে এবং অনেকের কপালে চিন্তার ভাঁজ এঁকে দেয়। অনেকে আবার এটিকে নিছক কাল্পনিক এবং অপ্রয়োজনীয় চিন্তাভাবনা বলে উড়িয়েও দেয়। বাস্তবে প্রশাসনিক, সামরিক কর্মকর্তা এবং নিরাপত্তা রক্ষী বাহিনীর মধ্যে প্রায়শই ট্রলি প্রবলেমের মুখোমুখি হতে হয়। এসবের বাইরেও, আধুনিক প্রযুক্তির যুগান্তকারী আবিষ্কার কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগে ট্রলি প্রবলেম আবারও অনেকের মনে চিন্তার দাগ ফেলছে। আর সেটি সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে সেলফ ড্রাইভিং কিংবা ড্রাইভারলেস গাড়ির ক্ষেত্রে। এ বিষয়ে আলোচনা করার আগে সংক্ষেপে জেনে আসা যাক সেলফ ড্রাইভিং গাড়ি এবং ট্রলি প্রবলেম নিয়ে।

সেলফ ড্রাইভিং গাড়ি

প্রযুক্তির অগণিত বিস্ময়ের মধ্যে একটি হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, যার হাত ধরে পুরো পৃথিবী চতুর্থ শিল্প বিপ্লব দেখতে চলেছে। মানুষের মস্তিষ্কের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা ছাড়া কম্পিউটার প্রোগ্রামের সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং সমস্যা সমাধানের ক্ষমতাকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (Artificial Intelligence) বা এআই বলা হয়। যেই গাড়ি কোন চালকের উপস্থিতি ছাড়া কিংবা চালকের আংশিক সহযোগিতার মাধ্যমে কম্পিউটার প্রোগ্রামের মাধ্যমে চালানো হয় তাকে সেলফ ড্রাইভিং গাড়ি বলা হয়। যেহেতু, এখানে মানুষের সিদ্ধান্ত নেয়া, মানবিকতা, পক্ষপাতিত্ব এসব বিষয়ের সুযোগ কম্পিউটারের ক্ষেত্রে থাকেনা তাই ট্রলি প্রবলেম এক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয়। জেনে আসা যাক ট্রলি প্রবলেম আসলে কি।

ট্রলি প্রবলেম

ধরুন, আপনি কোন এক সকালে পথ ধরে হেটে চলেছেন। খেয়াল করলেন আপনার পিছন দিকে লাইন ধরে একটি ট্রলি এগিয়ে আসছে। ট্রলিটা যতোই সামনে এগিয়ে আসছে, আপনি কিছু মানুষের আর্তনাদ শুনতে পেলেন। বুঝতে পারলেন, রেললাইনে পাঁচজন জলজ্যান্ত মানুষকে বেঁধে রাখা হয়েছে এবং ট্রলির ব্রেক অকেজো হয়ে পরায় সেটি তাদের দিকে দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছে। সৌভাগ্যবশত আপনার অদূরেই একটি হ্যান্ড লিভার বা সুইচ রয়েছে যার মাধ্যমে আপনি ট্রলিটাকে পাশের একটি লাইনে সরিয়ে দিয়ে গতিপথ পরিবর্তন করাতে পারবেন এবং ঐ পাঁচজন মানুষ বেঁচে যাবে।

আপনি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে লিভারের দিকে এগিয়ে গেলেন। কিন্তু তখনই দেখলেন পাশের বিকল্প লাইনটিতে একজন মানুষ হাত পা বেঁধে রাখা অবস্থায় পরে আছে। এখন স্বাভাবিকভাবেই আপনি দুশ্চিন্তায় পরে যাবেন। পাঁচজন মানুষকে বাঁচানোর জন্য কি আপনি একজন মানুষকে মারবার পথ বেছে নিবেন নাকি ঐ একজনকে বাঁচাবার জন্য পাঁচ জনকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিবেন?

গবেষকরা এই নৈতিক প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে দেখেছেন পরিস্থিতি ভেদে এবং ব্যক্তিত্ব ভেদে একেকজন একেকভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। মূলত, সুইচ বা লিভারের পাশে দাড়িয়ে থাকা ব্যক্তির পক্ষে এই পরিস্থিতিতে দুইটি সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভবঃ

  1. কিছু না করে যেভাবে হেঁটে যাচ্ছিলেন সেভাবে হেঁটে যাওয়া এবং পাঁচ জন মানুষকে মারা যেতে দেয়া
  2. লিভারটি টেনে ট্রলির গতিপথ পরিবর্তন করিয়ে পাঁচজনকে বাঁচানো এবং একজনকে মারা যেতে দেয়া

পুরো বিষয়টিকে উপযোগীতাবাদ (utilitarianism) এর খাতিরে চিন্তা করলে ঐ ব্যক্তির উচিত সর্বাধিক সংখ্যক মানুষের জীবন রক্ষা করা, অর্থাৎ চুপচাপ দাড়িয়ে না থেকে লিভার টান দিয়ে পাঁচ জন মানুষের জীবন বাঁচানো। অনেকের কাছে এটিই সঠিক সিদ্ধান্ত মনে হলেও আমাদের মাথায় রাখতে হবে এক্ষেত্রে একজন মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে। ঠিক এই জায়গাটিতে আলোচনায় চলে নীতিশাস্ত্রীয় মতবাদ। এই মতবাদ অনুযায়ী, যেকোনো সংখ্যক মানুষকে হত্যা করাই অন্যায়, সেটা একজন হলেও। এই মতবাদে বিশ্বাসীরা মনে করেন, পথচারীর উচিত তার প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে লিভার টেনে ট্রলির গতিপথ পালটে দিয়ে একজনকে হত্যা না করে ট্রলি যেভাবে যাচ্ছিলো সেভাবে যেতে দেয়া।

ট্রলি ডিলেমা ও সেলফ ড্রাইভিং গাড়ির সম্পর্ক

এখন মনে প্রশ্ন জাগতে পারে সেলফ ড্রাইভিং গাড়ির সাথে ট্রলি প্রবলেমের সম্পর্ক কোথায়। যদিও অনেকে এই দুটির মধ্যে সম্পর্ককে অমূলক মনে করে, কিন্তু একবিংশ শতাব্দীতে ট্রলি প্রবলেমের অন্যতম উপযুক্ত ক্ষেত্র হচ্ছে এই সেলফ ড্রাইভিং গাড়ি প্রযুক্তি। তবে একটা ভালো ব্যাপার হচ্ছে, লিভারের পাশে দাড়িয়ে থাকা ব্যক্তির হাতে যথেষ্ট সময় ছিলোনা চিন্তা ভাবনা করে সেরা সিদ্ধান্তে উপনীত হবার, কিন্তু সেলফ ড্রাইভিং প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করা প্রকৌশলী, প্রোগ্রামার, ডিজাইনার দের হাতে সেই সুযোগ আছে গবেষণা করে যন্ত্রের মধ্যে সেরা সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা তৈরি করার।

ট্রলি প্রবলেমের ট্রলির সাথে আমরা সেলফ ড্রাইভিং গাড়ির তুলনা করতে পারি। আর ছয়জন মানুষের সাথে তুলনা করা হয়ে থাকে একজন বৃদ্ধা ও শিশু কে। লিভারের পাশে দাড়িয়ে থাকা মানুষটি এক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন গাড়ির সফটওয়্যার যেটি গাড়িটিকে নিয়ন্ত্রন করে।

ধরুন, একটি গাড়ি পথ ধরে এগিয়ে যাচ্ছে, এমন সময় গাড়িটির সামনে একপাশে একজন বৃদ্ধা রাস্তা পার হচ্ছে, অপর পাশে একজন শিশু রাস্তা পার হচ্ছে। এক্ষেত্রে চলন্ত গাড়িটিকে যেকোনো একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে হবে যেকোনো একজনকে আঘাত করে আরেকজনকে বাঁচিয়ে দেবার মাধ্যমে। অথবা, এক্ষেত্রে আরও অনেকরকম সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব যার ফলাফল ও ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। যেমন, গাড়িটি চাইলে দুজনকেই বাঁচিয়ে দিতে পারে প্রচণ্ড জোরে ব্রেক কষে। কিন্তু এক্ষেত্রে গাড়িটির নিজের ক্ষতি হবার সম্ভাবনা কয়েকগুণ বেড়ে যায়, যার ফলে গাড়িতে থাকা মনুষ্য যাত্রীদেরকে বিপদের মুখে ঠেলে দিতে হচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কাকে বাঁচানো এক্ষেত্রে নৈতিক এবং যৌক্তিক ভাবে সেরা সিদ্ধান্ত হবে।

ঠিক এই কঠিন পরিস্থিতিতে যদি গাড়িটি একটি কম্পিউটারের বদলে একজন মানব চালক দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতো? তিনি এক্ষেত্রে কি সিদ্ধান্ত নিতেন? তিনি কি নৈতিকতা, যুক্তি, সামগ্রিক ক্ষতির হিসাব নিকাশ সঠিক ভাবে করে সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন কয়েক মিলি সেকেন্ডের মধ্যে? স্বাভাবিকভাবেই যেকোনো দুর্ঘটনার সম্মুখে আমাদের মস্তিষ্ক এতো শত হিসাব নিকাশ করে উঠতে পারেনা। তাই সেরা সিদ্ধান্ত নেয়াও সব সময় সম্ভব হয়না বলেই সড়কের দুর্ঘটনা গুলো এতো নির্মম হয়ে থাকে। কিন্তু একটি কম্পিউটার প্রোগ্রাম প্রকৌশলী এবং ডিজাইনার রা অনেক পরিক্ষা নিরীক্ষা, জল্পনা কল্পনা, জরিপ করেই তৈরি থাকেন বলে উপরিউক্ত পরিস্থিতিতে তুলনামূলকভাবে সেরা সিদ্ধান্তটি সেলফ ড্রাইভিং গাড়ির ক্ষেত্রে নেয়া সম্ভব হয়ে থাকে অনেক ক্ষেত্রেই। এর ফলেই, মানব চালকের দ্বারা সঙ্ঘটিত সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা সেলফ ড্রাইভিং গাড়ির দুর্ঘটনার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি।

কিন্তু, প্রশ্ন থেকেই যায় যে এরকম জটিল পরিস্থিতিতে একটি গাড়ির আসলে কোন সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত। গাড়ির সামনে থাকা মানুষ, পশু, গাড়ির ভিতরে থাকা মানুষ সবার একটি যৌক্তিক মূল্যায়ন করে গাড়িটিকে সিদ্ধান্তে উপনীত হতে হবে। ২০১৪ সালে এম আই টি মিডিয়া ল্যাব এই বিষয়টি নিয়ে একটি গবেষণা করে যার নাম Moral Machine. মোরাল মেশিন গবেষণার একটি প্রশ্ন-

এই গবেষণায় তারা এমন একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে যার মাধ্যমে ব্যাপক পরিমাণ মানুষের মতামত সংগ্রহ করা সম্ভব হয়। গবেষণায় দেখা যায় একেক সংস্কৃতি, অর্থনীতি এবং ভৌগলিক অবস্থানের মানুষ একই পরিস্থিতিতে ভিন্ন ভিন্ন মতামত দিচ্ছে। গবেষণাটি এক পর্যায়ে এতোই ভাইরাল হয়ে গিয়েছিলো যে ২৩৩ দেশের ৪০ মিলিয়ন মানুষ এতে অংশগ্রহণ করে। ন্যাচার-এ প্রকাশিত একটি গবেষণা পত্রে পরীক্ষাটির ফলাফল প্রকাশ করা হয়। পরীক্ষাটিতে মানুষের সামনে ৯ টি ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতি উপস্থাপন করা হয়-

  1. গাড়িটির কি পথে থাকা একটি পশুর চেয়ে মানুষকে বেশি গুরুত্ব দেয়া উচিত
  2. গাড়ির ভিতরে থাকা যাত্রীর গুরুত্ব কি পথচারীর চাইতে বেশি হওয়া উচিত
  3. নারীদেরকে কি পুরুষদের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া উচিত
  4. বেশি জীবন বাঁচানোটাই কি গাড়ির লক্ষ্য হওয়া উচিত
  5. তরুণদেরকে কি বয়স্কদের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া উচিত
  6. সবল কে কি দুর্বলের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া উচিত
  7. উচ্চ সামাজিক মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তির গুরুত্ব কি বেশি হওয়া উচিত
  8. আইন অমান্যকারীর গুরুত্ব কি কম হওয়া উচিত
  9. গাড়িটির কি এমন পরিস্থিতিতে যেভাবে চলছিলো সেভাবেই চলতে থাকা উচিত

গবেষণায় দেখা যায়, সমষ্টিবাদি সংস্কৃতির মানুষ যেমন জাপান কিংবা চীনের জনগণ বয়স্কদের চাইতে তরুণদেরকে গুরুত্ব কম দেয়ার পক্ষপাতী। অপেক্ষাকৃত দরিদ্র দেশের জনগণ আবার আইন অমান্যকারী পথচারীকে অধিক গুরুত্ব দেয়ার পক্ষে মতামত দেয়। আবার যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রের মতো ব্যক্তিবাদি রাষ্ট্রের মানুষ যেই সিদ্ধান্তে অধিক সংখ্যক প্রাণ বেঁচে যায় সেই সিদ্ধান্তে উপনীত হবার পক্ষে মত দিয়ে থাকে।

এই বিষয়ে আরও জানতে পড়ুনঃ